অনলাইন ডেস্ক:
বড় একটি চক্র বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ক্যাডার, নন-ক্যাডার পরীক্ষাসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করত। রাজধানীসহ দেশব্যাপী রয়েছে এই চক্রের বিস্তার। ফাঁস হয়েছে মেডিক্যাল ও নার্সিংয়ের প্রশ্নপত্রও। পিএসসির সাবেক গাড়ি চালক সৈয়দ আবেদ আলীর সঙ্গে প্রশ্নফাঁসে জড়িত এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ১০ কোটি টাকার চেকসহ মঙ্গলবার (৯ জুলাই) আটক করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই চক্রের আরও আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। হাইপ্রোফাইল কয়েকজন প্রশ্নফাঁসকারীর নামও জানা গেছে।
সৈয়দ আবেদ আলী জড়িত ছিলেন নগদ লেনদেন ও চাকরি প্রার্থী সংগ্রহের কাজে। পিএসসির সাবেক মেম্বার মাহফুজুর রহমান ছিলেন গাড়ি চালক আবেদ আলীর গুরু। পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন তারা। চক্রের সদস্যরা ওই পরীক্ষার আগের রাতে তাদের চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের বাসায় রেখে ওই প্রশ্নপত্র ও তার উত্তর দিয়ে দেন। তদন্তে এখন পর্যন্ত আরও অনেকের নাম সামনে এসেছে। হাইপ্রোফাইল কিছু নামও পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনবে বলে জানিয়েছে সিআইডি।
একইসঙ্গে সৈয়দ আবেদ আলীর হাত ধরে যারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। ২০১০ সালে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে আবেদ আলীর সম্পৃক্ততা পায় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়, তিনি স্বীকারও করেছিলেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসে কারা জড়িত, অন্যান্য প্রশ্নপত্র কীভাবে ফাঁস করা হয় সেই তথ্যও তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেন। ওই সময় এই ঘটনায় আবেদ আলীসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।তখন বিষয়টি পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়। সে সময় আবেদ আলী পিএসসির চেয়ারম্যানের কাছে অঙ্গীকার করেন যে, আর কখনো প্রশ্নফাঁস করবেন না। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই সময়ের চেয়ারম্যান পিএসসির আবেদ আলীসহ যে কয়জন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাদের চাকরিচ্যুত করেন। ২০১১ সালে শেরে বাংলা নগর থানায় আবেদ আলীসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় বিজি প্রেসেরও দুইজন কর্মকর্তা আসামি ছিলেন। ২০১৪ সালে বিচার কার্যক্রম শুরু হলে তখন মাত্র দুই জন সাক্ষীর জবানবন্দির গ্রহণ করা হয়। বর্তমান মামলাটি বিচারাধীন।
কিন্তু চাকরিচ্যুত হওয়ার পর আবেদ আলী প্রশ্নফাঁসের কাজটি পুরাদমে শুরু করেন। কয়েক শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। তার সঙ্গে বড় একটি গ্রুপ জড়িত। ওই সময় ভর্তি পরীক্ষার এই প্রশ্নগুলো বিজিপ্রেসের যারা টাইপ করতো, সেখানে ছিল আবেদ আলীর লোক। তারা প্রশ্নগুলো মুখস্থ করে ফেলতো। তারা সবাই মিলে প্রশ্নফাঁস করতো। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে পাঠাতো। সেই কোচিং সেন্টারগুলোও শনাক্ত করে গোয়েন্দা সংস্থা। তবে এদের পেছনে নেপথ্যের শক্তি এতো শক্তিশালী ছিল যে, তাদের কিছুই করা যায়নি।
ওই সময় বিজি প্রেসের একজন উপ-পরিচালকও প্রশ্নপত্র ফাঁসের হোতা ছিলেন। তার সঙ্গে সম্পর্ক আবেদ আলীর। তার দেওয়া ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যারা বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার হয়েছেন, তাদেরকে অনেকেই ‘আবেদ ক্যাডার’ হিসেবে ডাকছেন। আর এই আবেদ ক্যাডাররা আবেদ আলীকে রক্ষা করতে মরিয়া। তারা আবেদ আলী রক্ষা কমিটির মতো কাজ করছে। এমন তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। কারণ আবেদ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে, কারা কারা প্রশ্নফাঁসে উত্তীর্ণ হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাদের নাম বলে দেবে। এই আশংকা অনেকে করছেন। সকল বিসিএস ক্যাডারে আবেদ আলীর লোক রয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে তাকে বাঁচানোর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবেদ আলীর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এতে অনেকে বিব্রত বোধ করছেন।
এদিকে আবেদ আলীর প্রশ্নফাঁসে যারা প্রশাসনে ঢুকেছে তারা দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় লিপ্ত। তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনারও কাজ চলছে। পিএসসির সাবেক মেম্বার মাহফুজুর রহমান প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল হোতা। মক্কেল যোগাড় করেছেন নিজের গাড়ির চালক আবেদ আলীকে দিয়ে। পূর্বে পিএসসির দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক চেয়ারম্যান বলেন, আবেদ আলীকে সবাই সমীহ করে চলতো এবং ভয়ও পেত।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিএসসির মাধ্যমে মেধাসম্পন্ন অফিসার চাকরিতে প্রবেশ করে। মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনে যাবে। কিন্তু ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কেউ ডাক্তার হলে, সে কি ধরনের ডাক্তার হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশাসনে গেলে ভালো প্রশাসক হবে না। যে শিক্ষকতায় গেছে, সে ভালো শিক্ষক হবে না। স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মূলে থাকা মাহফুজুরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে দুই অপরাধ বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন। তাদের মতে, কত হাজার নিয়োগ পেয়েছে, সেটা যাচাই করতে হবে।
দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার জন্য তালিকা করে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে দেওয়া হবে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।