৭ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪
নিশান ডেস্ক: আজ ঐতিহাসিক সাত নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের জনগণ মিলে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব সংঘটিত করে, যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে সাত দফা গোলামী চুক্তি, ৩০ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের আনন্দকে ফিকে করে দেয়। এছাড়াও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুটপাট এবং এসবের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে দেয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহযোগিতা করলেও ভারত কখনোই বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক তা চায়নি। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকুক, কোন দৃঢ় ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি থাকুক- এটা ভারত চায়নি।
দেশ পরিচালনায় শেখ মুজিবের মত এক বিশাল মহীরুহের চরম ব্যর্থতায় বাংলাদেশ তখন প্রায় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় মিড লেভেলের অফিসার কর্তৃক এক সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা বিদেশে থাকায় এই হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পান। মুজিব পরবর্তীকালে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন রূপে রাষ্ট্রপরিচালনা করতে শুরু করে। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত অনেক নেতাকেই আটক করে জেলে নেয়া হয় যাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসানাত মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন (অব.) মোহাম্মদ মনসুর আলী অন্যতম।১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর আরেকটি হত্যাকাণ্ডে জেলখানায় উক্ত চার নেতা নিহত হন। এর আগের দিন অর্থাৎ ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। এই অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের জনগণ শংকিত হয়ে ওঠে যে, পুনরায় ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে সংঘটিত হয় সিপাহী-জনতার বিপ্লব।
এই বিপ্লবের সূচনা মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত তাহেরের নেতৃত্বে হলেও সেখানে ছিল একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অফিসার মুক্ত করে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল করে রাখা। কিন্তু সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার জেসিও ও সাধারণ সৈনিকরা কর্নেল তাহেরের এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে বিপ্লবের নেতৃত্বে নিয়ে আসে। ছিটকে পড়ে কর্নেল তাহের ও তার ষড়যন্ত্র। জিয়াউর রহমান তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। বাংলাদেশ সব ধরনের ষড়যন্ত্রমুক্ত হয়। এই বিপ্লবের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানকে দেখে দেশবাসী আশ্বস্ত হয় এবং জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ একসাথে রাস্তায় নেমে আসে স্বাধীনতার আনন্দে।মুক্ত বাংলাদেশে তারা ট্যাংকের উপর চড়ে বসে আনন্দ মিছিল করে। এভাবেই ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে সিপাহী জনতার এক বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার চেতনা মর্যাদা ও অহংকারে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। তবে এর মধ্যেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ‘সিপাহী-সিপাহী ভাই ভাই, জেসিও ছাড়া র্যাংক নাই’, ‘সিপাহী-সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’ স্লোগান দিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ফেলে।
এই সিপাহী-জনতার বিপ্লবের ৫০ বছর পর বাংলাদেশে একই ধরনের আরেকটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এটিও সিপাহী-জনতার বিপ্লব, সৈনিক-ছাত্র-জনতার বিপ্লব। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। শেখ হাসিনা তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরিচালিত ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুম, খুন, আয়না ঘর, সন্ত্রাস, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হরণ, লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার, নির্বাচন বিহীনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট করার জন্য দেশের স্বার্থ বিদেশিদের কাছে বিকিয়ে দেয়। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলী ভারতীয়করণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের প্লেটে কেকের মতো তুলে পরিবেশন করে শেখ হাসিনা সরকার। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যখন ভারতের একটি ছায়া উপনিবেশে পরিণত হতে চলেছিল, সেই সময় বাংলাদেশকে রক্ষা করতে আবাবিল পাখির মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তর থেকে নেমে আসে কিছু ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে তারা রাস্তায় নামলেও ধীরে ধীরে গোটা সংস্কারের নামে পুরো বাংলাদেশটা সংস্কারের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদের পতনের এক দফা আন্দোলনের ডাক দেয়। বিগত ১৫ বছরে বিরোধী দলগুলোর আহুত একের পর এক আন্দোলন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে যেভাবে দমন করেছে, ঠিক একই কায়দায় ছাত্রদের এই আন্দোলন দমনের কৌশল বেছে নিয়েছিল। কিন্তু এই ছাত্ররা ছিল দুর্দমনীয়, অদম্য। তারা ‘একটা গুলি খেলে একটাই যায়, বাকিটি যায় না।’ এই আতঙ্কে শেখ হাসিনার খুনি বাহিনী একের পর এক ভুল করতে থাকে।সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, গণ অধিকার ফোরাম, গণতন্ত্র মঞ্চ, মাদ্রাসা ছাত্ররা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রভৃতি ছাত্রদের এই আন্দোলনে কৌশলে সামিল হয়। তারা নিজেদের দলীয় পরিচয় এবং দলীয় পরিচিত নেতাদের ব্যবহার না করে স্বল্প পরিচিত নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিপুল পরিমাণে এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে। পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও এই আন্দোলনে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ফলে বাধ্য হয়ে শেখ হাসিনা কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনীকে আন্দোলন দমাতে রাস্তায় নামায়। কিন্তু মাঠে নামা সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার, জেসিও ও সাধারণ সৈনিকেরা এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের পরিবর্তে তাদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-সেনা-জনতার আন্দোলনে। সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা যারা শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী ও প্রবল অনুগত ছিলেন, তারা জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের এই অবস্থানে কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছাত্র-জনতা ও তার সৈনিকদের মনোভাব উপলব্ধি করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে রক্ষা করতে আন্দোলনকারীদের উপর শেখ হাসিনার গুলি চালানোর নির্দেশ উপেক্ষা করেন। ফলে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।শেখ হাসিনা তার লেসপেন্সার ও সহযোগীদের না জানিয়েই ভারতে পালিয়ে যান। লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতা ও সৈনিক মুক্তির আনন্দে সারা দেশের রাজপথে নেমে আসে। তারা মুহূর্তেই সারা দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের প্রতিটি আইকন ধ্বংস করে দেয়। ছাত্র-জনতা ফুল দিয়ে সেনাসদস্যদের অভিবাদন জানায়। সেনাসদস্যরাও ছাত্র-জনতাকে আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ারের উপরে উঠে বিজয়ের অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। ঠিক যেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পুনর্চিত্রায়ণ। একই বিপ্লব যেন ৫০ বছর পর পুনর্দৃশ্যায়ন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনী দুইবার ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে দেশের সার্বভৌমত্বকে মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এই অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা-সৈনিকের এই এই বিপ্লব, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের ধারাবাহিকতা। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের বিপ্লব যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারতো তাহলে আজকের এই ৫ আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লব হয়তো জাতি অবলোকন করতে পারত না। একটি বিপ্লব আরেকটি বিপ্লবের ধারাবাহিকতা। তাই একটি বিপ্লব আরেকটি বিপ্লবকে অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে মহীয়ান হতে পারে না। তাই আজকের বিপ্লবীরা সেদিনের বিপ্লবীদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন সেটাই দেশবাসীর কাম্য। একই সাথে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পরবর্তীকালে সেনাবাহিনী ও জনগণ একসাথে মিলে যেভাবে দেশকে রক্ষা করেছে, ভারতীয় রাহুর গ্রাস থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে রক্ষা করেছে, ঠিক একইভাবে ৫ আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতা, দেশপ্রেম ও সততার পরিচয় দেবেন এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।